মিনিকেট চাল: এ এক বড় ধোঁকা ও মরণ ফাঁদ!!
শুনলে অবাক হবেন, বাংলাদেশে মিনিকেট নামে কোনো ধান চাষ হয় না। তাহলে এই চাল আসে কোথা থেকে? এর উত্তর সহজ – মিনিকেট চাল তৈরি হয় কারখানায়। আমাদের দেশি মোটা চালকেই বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মিনিকেট চালে রুপান্তর করা হয়।
মোটা চাল থেকে মিনিকেট বানানোর তেলেসমাতি:
চালকলগুলোতে মোটা চাল আসার পর শুরু হয় আসল খেলা। প্রথমে ধানের খোসা ছাড়ানো হয়। এরপর চালের যে প্রাকৃতিক বাদামি আভা থাকে, তা রাসায়নিক পদার্থ ও হোয়াইটনার মেশিনের সাহায্যে আলাদা করা হয়। এই আবরণ বাদ দেওয়ার পর চাল কিছুটা সরু ও সাদা দেখায়। এখানেই শেষ নয়, এরপর পলিশার মেশিনে চালকে পলিশ করা হয় এবং তৈরি হয়ে যায় তথাকথিত “মিনিকেট চাল”।
চাল ব্যবসায়ীর লাভ, ক্রেতার ক্ষতি:
অনেকেই ভাবতে পারেন, মোটা চালকে এত প্রক্রিয়াজাত করে মিনিকেট বানালে তো চাল ব্যবসায়ীর ক্ষতি। কিন্তু হিসাবটা সম্পূর্ণ উল্টো! ১০০০ কেজি মোটা চাল প্রক্রিয়াজাত করে মিনিকেট বানালে প্রায় ৬ কেজি চাল বেশি পাওয়া যায়, যা মূলত জলীয় বাষ্প ও পানি। এছাড়াও, প্রক্রিয়াজাত করার সময় উৎপন্ন পলিশ রাইস ব্রান তেল কারখানায় বিক্রি হয়, সাদা খুদ বাজারে চালের অর্ধেক দামে বিক্রি হয়, এবং কালো খুদ ও মরা চাল পশুখাদ্য হিসেবে বিক্রি হয়। মোটা চালকে মিনিকেটে রূপান্তর করতে প্রতি কেজিতে খরচ হয় মাত্র ৯০ পয়সা থেকে দেড় টাকা। অর্থাৎ, বিক্রেতা সামান্য খরচ করে মোটা চালকে চিকন চালের দামে বিক্রি করে কেজিতে প্রায় ১৫ থেকে ২০ টাকা বেশি লাভ করেন।
পুষ্টিগুণবিহীন এ এক আবর্জনা:
ক্রেতার ছোট ক্ষতি হলো তিনি চিকন চালের দামে মোটা চাল কিনছেন এবং আর্থিকভাবে ঠকছেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো পুষ্টিগত দিক থেকে। প্রক্রিয়াজাত করার সময় চালের উপরিভাগের পুষ্টিকর আবরণ (Bran) বাদ দেওয়া হয়। এই ব্র্যানেই থাকে চালের প্রায় ৮৫% ভিটামিন B3, প্রোটিন, ফ্যাট, ৫১% খনিজ এবং ৮০% আঁশ। এছাড়াও ভিটামিন B1 ও ভিটামিন E থাকে এমব্রায়োতে, যা প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ, চালের সব পুষ্টিকর উপাদান আলাদা করে তেলের মিলে বিক্রির পর, যা পড়ে থাকে, তা আসলে চাল নয়, চালের আবর্জনা!
মিনিকেট চালের ভয়াবহতা
মিনিকেট চাল যতটা ক্ষতিকর মনে করছেন, বাস্তবে এর ক্ষতি আরও বেশি। মোটা চালকে মিনিকেটে রূপান্তর করার সময় সোডিয়াম হাইড্রোক্লোরাইড, সোডিয়াম হাইড্রোক্লোরাইড + টুথপেস্ট + এরারুটের মিশ্রণ, সয়াবিন তেল, ফিটকারি, বরিক পাউডার-এর মতো রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়। মজার ব্যাপার হলো, মিনিকেট চালে কখনো পোকা ধরে না। কারণ পোকাও বোঝে, এই চাল খাওয়ার অযোগ্য এবং এতে কোনো পুষ্টিগুণ নেই! আর এমন একটি অখাদ্যকেই আমরা নিশ্চিন্তে আমাদের পরিবারকে খাওয়াচ্ছি এবং নিজেরাও খাচ্ছি!
আমাদের ভবিষ্যৎ এবং সুস্বাস্থ্য
শুধুমাত্র চাল নয়, এমন আরও হাজারো অস্বাস্থ্যকর খাবার আমরা প্রতিনিয়ত জেনে বা না জেনে খাচ্ছি। এর ফলস্বরূপ আমরা ভুগছি কঠিন কঠিন রোগে, আর আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যাচ্ছি এক ভয়াবহ অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস। আমাদের পূর্বপুরুষরা কেমন খাবার খেয়ে জীবনযাপন করতেন, আর তাদের রোগবালাই বা চিকিৎসার ধরন কেমন ছিল, তা একটু জেনে নিলেই হিসাবটা মেলানো সহজ হবে। আজ আমরা নিত্য নতুন রোগে আক্রান্ত হচ্ছি আর নতুন নতুন ওষুধ সেবন করছি, যা একটি রোগ ঠিক করে আরও শত রোগের জন্ম দিচ্ছে। এ যেন এক চোরাবালিতে ডুবে আছি আমরা।
আসুন, সচেতন হই এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের দিকে ফিরে আসি। আপনার কি মনে হয়, আমরা আমাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে প্রস্তুত?