জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা সম্ভব কি?

Table of Contents

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা সম্ভব কি?

“তুমি কি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ো? তাহলে তো তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না!” – এই একটি বাক্য শুনে হাজারো তরুণ স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু আজ আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি—এই ধারণা ভুল। ভয়ংকরভাবে ভুল। তুমি যেখান থেকেই শুরু করো না কেন, গন্তব্য হতে পারে হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড কিংবা নাসা! – I mean it, seriously.

তুমি যদি এখনো এই লেখাটি পড়ছো, তবে বুঝে নিও—তোমার ভেতরে এখনও আশার আলো জ্বলছে। এখনই সময় সেই আলোকে প্রজ্বালিত করে পুরো জীবন বদলে দেওয়ার। বাস্তবে, শত শত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইতিমধ্যেই ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপে মাস্টার্স, এমফিল এবং পিএইচডি করছে।

আমিও এর সাক্ষী—বিশ্বজুড়ে কাজ করতে গিয়ে আমি অসংখ্য সফল মানুষকে দেখেছি, যারা এক সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে বসে স্বপ্ন দেখেছিল। আজ তারা গবেষক, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, এমনকি বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদস্থ কর্মী। তবে তার জন্য দরকার একটু পরিকল্পনা, একটু সাহস, আর নিজের উপর অগাধ বিশ্বাস। তোমাকে দিয়ে হবে না, এমন ভাবনা আর নয়!
________________________________________
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় (National University) একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশের বৃহত্তম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যা সারা দেশের ২,২৫৭টি কলেজ ও ইনস্টিটিউটের সাথে সংযুক্ত। এই বিশাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বর্তমানে প্রায় ৩৪ লাখ ২৫ হাজার ৮৩২ জন শিক্ষার্থী তাদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে, যা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করেছে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা এবং তাদের সাফল্য আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। তবে, এটাও সত্য যে – এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের মধ্যে অধিকাংশই বেকারত্বের সম্মুখীন, কিংবা পড়ালেখা রিলেভ্যান্ট ভালো জব পাচ্ছে না। এটি আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ, তবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আমরা সাফল্যের পথে এগিয়ে যেতে পারি।

তুমি যদি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হও, তাহলে তোমার সামনে অসংখ্য সম্ভাবনা রয়েছে। তোমার সিজিপিএ যদি উচ্চ নাও হয়, তবে হতাশ হবে না। ইংরেজি দক্ষতা বাড়িয়ে, আইইএলটিএস বা টোফেল পরীক্ষায় ভালো স্কোর করে, এবং জিআরই বা জিএমএটি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তুমি তোমার প্রোফাইলকে শক্তিশালী করতে পারো। এছাড়াও, গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ, প্রোজেক্টে কাজ করার অভিজ্ঞতা, এবং রিলেভ্যান্ট কো-কারিকুলার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ তোমার আবেদনকে সমৃদ্ধ করতে পারো।

বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য স্কলারশিপ বা ফান্ডিং পাওয়া সম্ভব। টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ (TA), রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ (RA), এবং গ্রাজুয়েট অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ (GA) এর মাধ্যমে তুমি ফান্ডিং পেতে পারো, যা তোমার টিউশন ফি, থাকা-খাওয়া, এবং অন্যান্য খরচ বহন করবে।

তুমি একা নও—তোমার পথচলায় আগে কেউ হাঁটতে পেরেছে…
তুমি হয়তো মৌলভীবাজারের কোনো গ্রামের ছেলে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গণিতে অনার্স করেছো। তুমি হয়তো সিলেটের মুরারি চাঁদ কলেজ থেকে মাস্টার্স করে আজ Texas A&M University-Commerce এ টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করছো। হ্যাঁ, এমনই করেছেন ইমরান হোসেন।

তুমি হয়তো চকবাজারের কোনো কম্পিউটার দোকানে কাজ করেছো, লেখা টাইপ করেছো, নিজের খরচ চালিয়েছো—তারপর ৩.১৬ সিজিপিএ নিয়ে বুয়েটে মাস্টার্স করে এখন University of Massachusetts Boston-এ পিএইচডি করছো। এটাই বাস্তব গল্প আশুতোষ নাথ-এর।

আরও অনেকে—আশরাফুল, সাজ্জাদুল, মরিয়ম, আশা বড়ুয়া—এরা কেউই নামি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল না। এরা ছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কিন্তু স্বপ্ন ছিল তাদের আকাশছোঁয়া। তোমার মতোই ঘুমহীন রাত, সীমিত রিসোর্স, কিন্তু সীমাহীন স্বপ্ন নিয়ে তারা আজ বিশ্বজয় করেছে।
________________________________________
তুমি কোথা থেকে এসেছো, সেটা মুখ্য নয়—তুমি কোথায় যেতে চাও, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ…
আমরা অনেকেই ভেবে নিই, “আমার GPA তো ৩.০ কিংবা তার কম, আমি কি পারব?” – হ্যাঁ, পারবে! কারণ সিজিপিএ খারাপ হলে GRE, IELTS-এ ভালো করে সেটা কভার করা যায়। একটি স্কিল কম থাকলে অন্যটাকে শক্ত করে তুলো। যারা সফল হয়, তারা সবসময় কোনো না কোনো পথ বের করে নেয়।
________________________________________
তুমি যদি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হও, তবে তোমার হাতে আছে অমূল্য সম্পদ—’সময়’…
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হয়তো প্রতিদিন ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, ল্যাব আর টেস্টে ডুবে থাকে। তুমি?
তোমার হাতে তুলনামূলকভাবে বেশি সময়—এই সময়টাই তোমার সবচেয়ে বড় শক্তি। এই সময়টাই কাজে লাগাও:
• IELTS, GRE শিখতে
• রিসার্চ ও পাবলিকেশন করতে
• অনলাইন কোর্স, ইন্টার্নশিপ, ভলান্টিয়ারিং করতে
• নিজেকে গড়ে তুলতে
________________________________________
তোমার স্বপ্ন যদি আকাশ ছুঁয়েছে, তাহলে তুমি নিচে পড়ে থাকবে কেন?…
তুমি কি জানো, University of Southern Mississippi-তে এখন পড়ছে এমন একজন যার সিজিপিএ ছিল মাত্র ২.৯১?
তুমি কি জানো, কেউ NASA-এর প্রজেক্টে কাজ করছে যিনি পড়েছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে?
তুমি নিজেকে ছোট মনে করো কেন?
তুমি যদি নিজেকেই নিজে বিশ্বাস না করো, কেউ করবে না।
________________________________________
তুমি চাইলে যেতে পারো—গুগল, নাসা, ফেসবুক, ইউএন-এ। তুমি চাইলে হতে পারো প্রফেসর, বিজ্ঞানী, উদ্যোক্তা।
তোমার পরিচয় ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র’ নয়, তোমার পরিচয়—যে হার মেনে নেয় নাই, যে স্বপ্ন দেখেছে, যে পথকে বানিয়েছে নিজের পায়ের নিচে।
________________________________________
তোমার প্রস্তুতির জন্য প্রাথমিক কিছু পথনির্দেশনা (বিস্তারিত সামনে লিখব)

১. ৩.২+ GPA টার্গেট করো, তবে ২.৫+ তেও স্কলারশিপ পাওয়া সম্ভব। GPA শুধু সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়, এটা তোমার অধ্যবসায়ের প্রতিচ্ছবি। যত ভালো রেজাল্ট, ততই স্কলারশিপ/ ফান্ডিং সম্ভাবনা, তবে ৩.৫+ হলে সম্ভাবনা অনেকগুণ বাড়ে।
২. IELTS প্রস্তুতি নাও—৬.৫ বা তার বেশি স্কোর করো। তবে চীন, মালয়েশিয়া, রাশিয়ায় অনেক স্কলারশিপ IELTS ছাড়াও মেলে।
৩. GRE/TOEFL – GRE ৩০০+, TOEFL ৯০+ ভালো লক্ষ্য।
৪. সিভি, SOP, মোটিভেশন লেটার ভালভাবে লিখা প্র্যাকটিস করো
৫. রিকমেন্ডেশন লেটার নিয়ে আগেই প্রস্তুতি নাও। প্রফেসরের সাথে সম্পর্ক তৈরি করো, তাঁর কাছ থেকে আগেভাগেই অফিসিইয়াল প্যাডে লেটার নিয়ে রাখো।
৬. প্রজেক্ট ও রিসার্চে যুক্ত হও (অনলাইন কোর্সের মাধ্যমে হলেও)। “জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা রিসার্চ করতে পারে না”—এই ভ্রান্ত ধারণা ভেঙে দাও। রিসার্চ সুযোগ কাজে লাগাও।
৭. TA/RA/GA ফান্ডিং-এর সুযোগ খুঁজে বের করো।
৮. ইন্টারভিউ, কমিউনিকেশন স্কিল প্র্যাকটিস করো। বক্তৃতা, রিসার্চ, ভলান্টিয়ারিং—সবই তোমার প্রোফাইলে যোগ্যতা বাড়াবে।
৯. তালিকা তৈরি করো বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কলারশিপ নিয়ে। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কী প্রয়োজন, কীভাবে আবেদন করতে হয়—তৃতীয় বর্ষেই এগুলো রিসার্চ করে ফেলো।

নিজের ভাগ্য নিজেই গড়ো…

তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম যত বড় হোক না কেন, তোমার পরিচয় হবে তোমার কাজ দিয়ে। তুমি আজ ২০ হাজার টাকার চাকরির কথা ভাবছো, অথচ একই সময়ে কেউ স্কলারশিপ নিয়ে ২০ লাখ টাকার সমমানের মাস্টার্স করছে ইউরোপে, সপ্তাহান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি। তুমি চাইলেই পারো! শুধু দরকার বিশ্বাস আর উদ্যোগ!
স্কলারশিপ মানে শুধু টাকাই নয়—এটা হলো নতুন জীবনের দরজা। এটা সম্মান, স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদা।
________________________________________
তোমার পরিচয় নির্ধারণ করে না তুমি কোথা থেকে এসেছো, বরং তুমি কী হতে চাও…
তুমি হয়তো এখনো নিজেকে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র ভাবো। অথচ বিশ্বাস করো—তুমি সঠিক প্রস্তুতি নিয়ে, নিজেকে গড়ে তুলে, এই পৃথিবীর যেকোনো মঞ্চে দাঁড়াতে পারো।

তুমি একদিন হয়তো এমন জায়গায় থাকবে, যেখানে লেখা থাকবে—
“Former National University student of Bangladesh. Now a Global Leader.”

________________________________________
তোমার হাতেই রয়েছে তোমার ভবিষ্যৎ। দেশেই থেকো কিংবা বিদেশে যাও—সিদ্ধান্ত তোমার। তবে মনে রেখো, এই বিশ্বে তোমার জায়গা কেউ তোমাকে ‘দিয়ে’ দেবে না—তোমাকেই তা ‘তৈরি’ করে নিতে হবে। ধৈর্য ধরো, সময় দাও, প্রস্তুতি নাও—সাফল্য তোমার হবেই।

শুরু হোক তোমার গল্প, আজ থেকেই। তুমি পারবেই।
………………..
বিদেশে উচ্চশিক্ষার সম্পূর্ণ গাইডলাইন
Dr-Ashiqur Rahman

Leave a Comment